টিটো
কখনও কখনও সকাল থেকেই আকাশ জুড়ে থমকে থাকে ঘন কালো মেঘ, ওই মেঘ চোঁয়ানো ঘোলা আলোর বিষন্নতা গায়ে মাথায় মেখে আমাদের খুব চেনা চারপাশটা যেন দমবন্ধ করে অপেক্ষা করে কোন অজানা আশঙ্কায়, মাঝে মাঝে গাছের পাতা সামান্য কাঁপিয়ে দেওয়া রুগ্ন বাতাসের বুকেও চেপে বসে থাকে রক্তের গন্ধ। চোখের আড়ালে সারাক্ষণ চলতে থাকে ষড়যন্ত্রের ফোঁসফোঁস, কান পাতলেই শোনা যায় আততায়ীর ফিসফিস। এই চাপা আতঙ্কের আবহাওয়া নিয়েই শুরু হয় বন্য প্রেমের গল্প, সিজন টু, আর যার রেশ রয়ে যায় একেবারে শেষ পর্ব অব্দি।
সিরিজের প্রথম পর্বে প্রথম দৃশ্যই বাঙালি দর্শকদের জন্য ঝাঁকিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, “মির্জাপুর” বা “ঘুল” ছাড়া এই নৃশংসতা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বিশেষ দেখেছি বলে মনে পড়ে না। মৃণালিনী চক্রান্তে সুব্রতর জেলে যাওয়ার পর কেটে গেছে দু-দুটি বছর আজ মৃণালিনীর জায়গা এক মেন্টাল অ্যাসাইলামে,আর এই অ্যাসাইলাম কেন্দ্র করেই গল্প বুনেছেন এই সিরিজের পরিচালক ও কাহিনীকার। এবার একে মেন্টাল অ্যাসাইলাম তারপরও আবার সাইকোলজিকাল থ্রিলার শুনেই যারা ভেবে নিচ্ছেন যে এবার গল্প “শাটার আইল্যান্ড” অথবা অন্তত পক্ষে “স্টোনহার্স্ট অ্যাসাইলামের” পথে কিছুদূর হলেও হাঁটতে বাধ্য, তারপর না হয় নবকুমারের মত পথ ভুলে আবার নতুন কোন প্লটে এসে পৌঁছবে, তারা অচিরেই নিজের ভুল বুঝতে পারবেন আমি আর স্পয়লার দেওয়ার অপরাধে করবো না। সিজন ওয়ান এর শর্ত মেনে রয়েছে অপরাধ রয়েছে যৌনতা সঙ্গে রয়েছে এক নতুন উপাদান প্রতিশোধ যদিও শেষ পর্বের শেষ দুই তিন মিনিটের আগে যার আজ অব্দি পাওয়া সম্ভব নয় আর ওই অল্প সময়ের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে বন্য প্রেমের গল্প নামটির সার্থকতা না হলে গোটা সিরিজে প্রেমকে সেভাবে গুরুত্বই দেওয়া হয়নি।
এবার আসি অভিনয়ের কথায়। প্রথমেই বলতে হয় পুলিশ অফিসার বীণাপাণি ব্যানার্জির চরিত্রে দামিনী বসুর কথা। রক্ষ, পুরুষালী, মুখ আলগা বীণাপাণি যতবারই দেখা দিয়েছেন, ওঁর থেকে নজর ঘোরানোর মুশকিল হয়েছে, যদিও চিত্রনাট্যে সমর্থন তিনি পুরোপুরি পেয়েছেন কিন্তু সেই সমর্থনকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর কৃতিত্ব একেবারেই দামিনীর। বডিল্যাঙ্গুয়েজ, উচ্চারণ, অভিব্যক্তি, সব মিলিয়ে অসাধারণ নম্রভাষী, সংবেদনশীল, অনুভবি সাইক্রিয়াটিস্ট কনিষ্কের ভূমিকায় অর্জুন নিজেকে পুরো ঢেলে সাজিয়েছেন। অপরাধের ইতিহাস যার সঙ্গে জুড়ে থাকে তাকে ক্লিনচিট দেওয়া তো অবশ্যই মুশকিলের, তাই এই সিজনে জানা এবং অজানা অপরাধের ভারে ভারাক্রান্ত মৃণালিনী প্রায় শুরু থেকেই কনফিউজড এবং ভালনারেবল। রুমকির উপর নির্ভরশীলতা অন্যান্য আবাসিকদের প্রতি দায়িত্ব এবং কনিষ্ককে ভালোলাগার অনুভূতিগুলো প্রত্যেকটি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তনুশ্রী। এই তিন চরিত্রের পাশে যথেস্ট নজর টেনে রাখেন অদ্রিজা। এছাড়াও জাহাঙ্গীর, ধর্মেন্দ্র, স্বাতী, জয়। প্রত্যেকটি চরিত্রের অভিনেতারাই প্রায় লেটার মারকস সমেত উতরেছেন। এদের মধ্যে অবশ্যই অদিতির চরিত্রে চাঁদনী সাহার অভিনয় আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে। আগের সিজনে ধুন্ধুমার ব্যাটিং এর পরেও যে পরিচালক এনা সাহার অভিনয় প্রতিভার প্রেমে না পড়ে গোটা সিরিজে এনাকে নিয়ে প্রায় লুকোচুরি খেলে ক্লাইম্যাক্সে একটা ধাপ্পা দেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন সেটা একেবারে দশে দশ পাওয়ার মতো।
এবারে অভিযোগের পালা। সবকিছুর পরে ওই দু-একটি থেকেই যায় আর কি। আগের সিজনে “সোয়েটার” ছবির “প্রেমে পড়া বারণ…” এর মত জনপ্রিয় এবং মেলোডিয়াস গানের একটি গায়ে কাঁটা দেওয়া দৃশ্যায়ন দেখা গিয়েছিল,এবারেও অপেক্ষায় ছিলাম এমন একটা বাম্পার চমকের। অ্যাসাইলামে যোগ দেওয়ার প্রথম রাতেই কনিষ্কের সঙ্গে অদিতি ও মৃণালিনীর প্রথম ইন্টারেকশন এর সংলাপগুলি যে উৎকণ্ঠা তৈরি করল তা কি শুধুই চমক দেওয়ার জন্য? ওই দৃশ্যের ফলশ্রুতি তো আর কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না! আগের সিজনের মত এবারেও ক্লাইম্যাক্সে শুধুই কথোপকথন, যদিও দর্শক হিসেবে সংলাপে উল্লেখ করা ঘটনাবলীর ভিজুয়াল ইন্টারপ্রিটেশন আশা করেছিলাম ভীষণভাবে। মৃণালিনীর অপরাধ ধরা পড়া, অ্যাসাইলামে এসে পৌঁছানো, রুমকির সঙ্গে বন্ডিং তৈরি হওয়ার পুরো বিষয়টাই তো অন্ধকারে রয়ে গেল! তাহলে কি এবার একটা প্রিক্যুয়েল? সে তো ভবিষ্যৎ ই বলবে, কিন্তু বর্তমানের সত্যিটাও একবার জানা যাক। এর আগে এমন গুমোট সাসপেন্স, জমাট রোমাঞ্চ, টানটান চিত্রনাট্য, মাইন্ডব্লোয়িং ট্যুইস্ট আর দুরন্ত অভিনয়ের ককটেল দেখার সুযোগ বাঙালি দর্শকদের খুব বেশি হয়নি এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়।
Leave A Comment
You must be logged in to post a comment.